রাতের আঁধার কাটেনি তখনো। ঘুম ঘুম চোখে তাঁবুর বাইরে এসে তাকায় অথৈ। চাঁদটা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আবার ফুটে উঠছে ফুলের মত। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে খিদেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। অর্ধাহার চলছে কয়েকদিন ধরে। তবে খিদেটা বাড়িয়ে দিয়েছে একটি আশা, কিংবা আশ্বাস। পাশের গ্রামের কে একজন আজ মুরগী পাঠাবে শরণার্থী শিবিরে। কাল দুপুরে শিবিরের তত্ত্বাবধায়ক নিজে বলে গেছেন। লাল লাল ঝোল আর হলদে আলুর মাঝখানে দ্বীপের মত জেগে থাকা মুরগী নামের পাখিটার মাংসের টুকরোর স্বপ্ন শেষরাতেই ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল নয় বছরের মেয়েটাকে।
সকালে খাবার প্রতিদিন পাওয়া যায় না। ছোট একটা মাটির বদনায় পানি নিয়ে কয়লা দিয়ে দাঁত ঘষতে থাকে অথৈ। মাত্র সাত-আট মাসে জীবনটাই পালটে গেছে তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে ছিল বাসা। ‘পাখির নীড়ের’ মত বাসা, বাবা বলতেন প্রায়ই। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়াতেন। পঁচিশে মার্চের কালরাতে ওলটপালট হয়ে গেল ঘর, শহর আর দেশটা। ওরা যখন পালিয়ে বের হচ্ছিল সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল রক্তাক্ত মৃতদেহ। মায়ের কোলে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল অথৈ।
প্রথমে গ্রামে উঠেছিল ওরা। হানাদার ঢুঁকে পড়ে এখানেও। একটা বড় নৌকা করে আরও অনেকের সাথে উঠে পড়ে সবাই। সীমান্ত পাড়ি দিলেই ভারত। অন্য একটা দেশ। নিরাপদ আশ্রয়। কয়েকটা দিন শুধু চিড়া, মুড়ি, গুড় আর ভাগ্য ভালো হলে ফল জুটে গেলে সেই ছিল ওদের আহার। শরণার্থী শিবিরে এসে অবাক তাকিয়ে থাকে অথৈ। বিশাল বড় বড় তাঁবু টানানো। এর নিচে গাদাগাদি করে আছে অসংখ্য মানুষ। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া অথৈ গুনে শেষ করতে পারেনা। সবাই ওদের মত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ থেকে এসেছে? প্রথমদিনই ও বুঝতে পারে কতটা সৌভাগ্য ওদের। এখানে কেও হারিয়েছে বাবাকে, কেও মা’কে। কেওবা দুজনকেই। কিংবা সন্তান হারিয়ে একলা আসতে পেরেছে কেও কেও। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে অথৈ। ‘আমাকে ছেড়ে কোনদিন চলে যেওনা, মা’।
কয়েকদিন পর ওরা চলে যায় আরেকটা শিবিরে। এখানে লোক আগের তুলনায় কিছু কম। তবু একশ হবেই। ওর বাবা এখন গান লিখেন, কবিতা লিখেন। স্বাধীন বাংলা বেতারে সেই গান বাজতে থাকে। অনু, ফাতেমা, কিশোর, মণি, কয়েকটা বন্ধু জুটে যায় কয়েকদিনে। ওরা সকালে গল্প করে, বিকেলে গল্প করে। গল্প করে দুঃখ, খিদে ভুলে থাকে। ঘর থেকে পালিয়ে আসার যন্ত্রণা কমাতে চায়।
দুপুরে শিবিরে মোটা চালের ভাত, লাবড়া আর টলটলে ডাল দেওয়া হয়। প্রথম প্রথম কষ্ট হত খুব। রাতে লাল রুটি আর ‘ঘোড়ার ডাল’। মোটা মোটা ডালগুলো নাকি আসলে ঘোড়াদের খাদ্য, কে যেন বলেছিল একদিন। গলা দিয়ে নামত না ঠিকমতো। অথৈ লাবড়া দিয়ে ভাত খাওয়া শিখে গেছে। কোয়ার্টারের মত মাছ কিংবা মাংসের তরকারি দিয়ে মাখা ভাত নিয়ে এখন আর মা’কে ওর পিছনে দৌড়াতে হয়না।
সেই ভাতও এক-দুইদিন পাওয়া যায়না। শুধু রুটি আর ডাল দিয়ে দুপুরটা চলে যাচ্ছে তিনদিন ধরে। কাওকে কিছু বলারও নেই। পরবাসে আশ্রিত তারা। এর বেশি কী আর চাওয়া যায়। কাল দুপুরে তবু এলো সেই সুসংবাদ। ‘কার্তিকপুরের বড় কর্তা কাইল আপনাদের জন্য চাল আর সব্জি পাঠাবেন। মুরগীও আসতে পারে। কষ্ট করি আইজ একবেলা চালায়া নেন’।
স্বপ্নের শুরু তখন থেকে। মুরগী, লাল ঝোল আর নরম আলুর মত স্বপ্ন। এতদিনের কষ্ট ভুলিয়ে দেওয়ার মত উপশম। ছোকরার দলে ঈদ নেমে আসে। বড়দের চোখেও খুশির ঝিলিক। সেই আনন্দে ঘুম ভেঙে যায়। সকাল হতেই প্রস্তুত হয়ে বসে থাকে শরণার্থী শিবিরের অসহায় লোকগুলো।
বড় তাঁবুর নিচে বসে আছে সবাই। মাটির সানকিতে গরম গরম ভাত উঠে প্রথমে। সেটাই মুখে দিয়ে চিবুতে ইচ্ছে করে। তারপর আসে লাবড়া। আলু, বেগুন, মূলা, কাঁচকলা মিলে মিশে একাকার। অথৈ এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। নাক দিয়ে লম্বা করে শ্বাস টেনে দেখে। মুরগীর কোন গন্ধ নেই। লাবড়া দিয়েই গোগ্রাসে গিলতে থাকে উপোষী মেয়েটা। এরপর ডাল। টলটলে নয় আজ। একটু মাখামাখা। সেই ডাল দিয়ে ডলতে থাকে বাকি ভাত। স্বাদটাও আজ অন্যরকম। শেষের দিকে এসে খাওয়ার গতি কমিয়ে দেয় অথৈ। দেখা যাবে সে উঠে গেছে আর তখনই দিবে মুরগীর সালুন। সে ভালো করে খেয়াল করে, সবাই আজ খুব ধীরে ধীরে খাচ্ছে। উঠার নাম নেই কারও। সবাই কি যেন খুঁজছে।
মন খুব খারাপ করে খাওয়া শেষ করে অথৈ। যদিও আজ তার খুশি হওয়ার কথা। কতদিন পর পেট পুরে খেতে পেরেছে সে। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙার বেদনা নিদারুণ। উঠতে যাবে তখনই ভেতরে আসেন তত্ত্বাবধায়ক। মুখ তার কালো।
‘দাদা, কিছু মনে কইরেন না। মুরগী দিবেন কইছিলেন? মুরগী আসে নাই, তাই না’?
‘আইছে’।
‘দিলেন না যে? রাইতে দিবেন দাদা’?
‘না। রাইতে রুটি, ডাল’?
‘আমাগো হকের মুরগী। কই গেলো মুরগী? এইটা কেমন বিচার’?
‘এইটা সুবিচার’।
‘মশকরা করেন? আশ্রয় দিছেন বইলা ঠাট্টা করেন’?
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রাখেন তত্ত্বাবধায়ক। চোখ জ্বলজ্বল করছে তার।
‘কাইল রাইতে আনাজপাতি আসে। সাথে তিনটা মুরগী। কয়টা? তিনটা। আপনারা সব মিলে আছেন দেড়শর মত লোক। এখন আপনেরাই বিচার করেন আমি এই তিন মুরগী সবাইরে কেমনে বাট করি। কেও পাবে, কেও তাকিয়ে থাকবে, কেও জানবেও না। এমন আমি করতে পারিনা’।
থেমে যান তিনি। তাঁবু নিস্তব্ধ।
‘মুরগীগুলান কাইটা আমি পিষতে বলছি। সেই মিহি মাংসের গুড়া মিশিয়ে দিছি ডালের সাথে। কে বলে মুরগী পান নাই? উপরওয়ালার কসম, মুরগী আমি সমান বাট করছি। সবাই সমান পরিমাণে পাইছেন। কি, পান নাই মুরগী’?
বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস। শীত নামছে ঝুপ করে। শুষ্ক চোখে দূরের ডুবতে বসা সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে অথৈ। একসময় সূর্য ডুবে যায়। সন্ধ্যার অন্ধকার সংকীর্ণ করে দেয় দৃষ্টিসীমা। ‘স্বাধীনতা’ নামের অধরা স্বপ্ন তবু জ্বলজ্বল করতে থাকে কচি দুই চোখে। কাল আবার সূর্য উঠবে। নতুন একটা সূর্য। উঠবে তো? স্বাধীনতা নামের না দেখা সেই সূর্য?
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
নতুন সূর্য মানে নতুন একটি দিন। নতুন দিন মানে নতুন সম্ভাবনা, আশা, পরিবর্তন। জাতিগতভাবে নতুন সূর্য বলতে স্বাধীনতা নামের নতুন একটি অভিজ্ঞতা। এই গল্পে একাত্তরে শরণার্থী শিবিরে একটি বাচ্চার চোখে স্বাধীনতার জন্য প্রতিক্ষাকে নতুন সূর্য দিয়ে তুলনা করা হয়েছে।
২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৪২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪